ইসলামে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব (পর্ব-৩)
মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম
বিবাহে অভিভাবকের ভূমিকায় :
বিবাহের ক্ষেত্রে যেসব মধ্যপন্থার লংঘনব্যাপক, অভিভাবকের ভূমিকার বিষয়টিওতার অন্যতম। বাড়াবাড়ি দুদিক থেকেই হয়।খোদ অভিভাবকের দিক থেকেও এবংছেলেমেয়ের দিক থেকেও। দাপুটেঅভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদের মতামতকেগুরুত্ব দেয় না। তাদের কাছে নিজেদেরইচ্ছাই শেষ কথা। ছেলেমেয়ের ইচ্ছা-অভিরুচিকে অবজ্ঞা-অগ্রাহ্য করে নিজেদেরখেয়াল-খুশিমত বিবাহ মেনে নিতেতাদেরকে বাধ্য করে। চিন্তা করছে নাবিবাহটা তাদের ছেলের বা মেয়ের। একত্রেঘর-সংসার তারাই করবে। বিবাহেরভালোমন্দ ফল তারাই ভোগ করবে। কাজেইস্ত্রী বা স্বামী নির্বাচনের আসল হক তাদেরই।সে হক থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা নির্ঘাতজুলুম। অভিভাবকত্বের গুমরে সে জুলুমকরার কোন অধিকার তাদের নেই। আরঅনধিকার হস্তক্ষেপ তথা জুলুমের পরিণামকখনওই শুভ হয় না। জুলুম হল জুলুমাত বাবহুমাত্রিক অন্ধকারের উৎস। সেই অন্ধকারথেকে নানা অমঙ্গল জন্ম নেয়। প্রথমেইছেলে মনে করে স্ত্রী হল তার উপরঅভিভাবকদের পক্ষ থেকে এক চাপিয়েদেওয়া বিপত্তি। কিংবা মেয়ে মনে করে তারঅভিভাবক তাকে ধরে বেঁধে অজানাঅন্ধকারে নিক্ষেপ করল। এহেন ভাবনারসাথে স্বচ্ছন্দ দাম্পত্যের আশা দুরাশামাত্র।শুরু থেকেই তারা একে অন্যকে বাঁকাদৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। ফলে সব কিছুতেকেবল খুঁতই চোখে পড়ে। ভালোটাও যেনঠিক ভালো মনে হয় না। এভাবে অন্তরে ঘৃণাও বিদ্বেষ দানা বাঁধতে থাকে। অভিভাবকদেরশত চেষ্টাতেও তা দূর করা সম্ভব হয় না।অগত্যা হয় সারাটা জীবন অশান্তির আগুনেজ্বলতে থাক, নয়ত মিছে শান্তির সন্ধানেমরীচিকার পেছনে ছোট আর দ্বীন ও ঈমানসব বরবাদ কর, তা না হলে ছাড়াছাড়ির পথধরে নতুন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হও। এই যে, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি তাদের জীবনে দেখাদিল দৃশ্যত এটা তাদের ইচ্ছা-অভিরুচিকেঅগ্রাহ্য করারই কুফল। সংগত কারণেইঅভিভাবক তার দায়ভার এড়াতে পারে না ।ফলে অনুভূতিসম্পন্ন অভিভাবকেরাআপনমনে নিজেদের দুষতে থাকে এবং প্রিয়সন্তানের এহেন দুরাবস্থার ঘটয়িতা হিসেবেমনে মনে দারুণ গ্লানিবোধ করে। আবারবোধ-অনুভবের ঘাটতি যাদের আছে তারাসবটা দায় নিয়তির উপর চাপিয়ে নিজেকেবেকসুর খালাসও দিয়ে ফেলে। তা নিজেরানিজেদের যতই খালাস দিক না কেনভুক্তভোগী সন্তানও কি সে রায় সর্বান্তকরণেমেনে নেয়? তাদের মনে কি এর বিরুদ্ধেকোনোই আপত্তি থাকে না? অধিকাংশেরইথাকে এবং সারা জীবনের জন্য সেইঅভিভাবক তাদের চোখের-মনের কাঁটায়পরিণত হয়। এভাবে পিতামাতা-সন্তান-কেন্দ্রিক জগতের সর্বাপেক্ষা শক্ত বাঁধনের ওসর্বাপেক্ষা আপনার ভূবনটি ক্ষোভে, অনাস্থায় ও আত্মগ্লানিতে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে বহু ছেলেমেয়েও তাদের বিয়েতেঅভিভাবককে মূল্যায়ন করে না। তারানিজেরাই নিজেদের বিবাহ সেরে ফেলছে।সাম্প্রতিককালে এরকম বিবাহের হিড়িকপড়ে গেছে এটা সহশিক্ষা, পর্দাহীনতা ওঅবাধ মেলামেশার কুফল। তরুণ-তরুণীরাপরস্পর কাছাকাছি আসার সুযোগ পাচ্ছে।সেখান থেকে ঘনিষ্ঠতা, পরিশেষে বিবাহ।অভিভাবককে জানানোরও দরকার মনেকরছে না বা এই ভয়ে জানাচ্ছে না যে, তারাঅমত প্রকাশ করতে পারে এবং বাধা দিতেপারে। কোনভাবে যদি জেনে ফেলে এবংসর্ববিচারে মনঃপুত না হওয়ায় বাধা দেওয়ারচেষ্টা করে, তবে তাদেরকে দুশমন ঠাওরিয়েতাদের স্বপ্নকে ধূলিস্যাত করে দিয়ে গোপনেবিবাহ সেরে ফেলছে। তা সাক্ষী রেখে বিবাহকরলে বিবাহ বৈধ হল বটে, কিন্তু এক তোগুপ্ত বিবাহ ইসলামে পছন্দনীয় নয়, দ্বিতীয়তঅভিভাবকবিহীন বিবাহও পুরোপুরিইসলামসম্মত নয়। এরূপ কখনও সুষ্ঠু ওসুন্দর হয় না। এর পরিণাম শুভ হয় না এবংএর অধিকাংশই টেকসই হয় না। হওয়ারকথাও নয়। দুজন তরুণ-তরুণী যখনপরস্পর ঘনিষ্ঠ হয় তখন তাদের দুজনইঘোরের মধ্যে থাকে তারা একে অন্যের দ্বারাচরম নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কোনও রকমবিবেচনাবোধ তাদের মধ্যে কাজ করে না।একথা ভাবারই অবকাশ হয় না যে, তারাএকে অন্যের জন্য উপযুক্ত কি না। পন্থাটাইযেহেতু বদদ্বীনী তাই দ্বীনদারীর ক্ষেত্রেপারস্পরিক সমতা-সাযুজ্য দেখার তো প্রশ্নইআসে না, এমনকি সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেতারা পরস্পর সমপর্যায়ের কি না সে প্রশ্নওসম্পূর্ণ উপেক্ষিত থাকে। ফলে ঘরে ঘরেআজ অসম বিবাহের হিড়িক। বাড়িওয়ালারমেয়ে তার গাড়ির ড্রাইভারের সাথে চলেযাচ্ছে। কিংবা তার ছেলে কাজের মেয়েকেবিবাহ করছে। ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে পাড়ারকোনো অশিক্ষিত বখাটের সাথে ঘড়ছাড়ছে। অপরিণত বয়সের ছেলে মায়েরবয়সী কারও সাথে ফেঁসে গেছে কিংবাকোনো আনকোড়া কিশোরী পক্ককেশপ্রৌঢ়ের গলায় ঝুলে পড়ছে। এজাতীয়অসম পরিণয় কী পরিণতি বয়ে আনতেপারে তা বলাই বাহুল্য। দু-চার দিন পর মোহযখন ঘুচে যায়, চোখ আপনিই খুলে যায়।জীবনের কি সর্বনাশ করে ফেলেছে তা চাক্ষুসদেখতে পায়। অমনি পরস্পর ঘৃণা-বিদ্বেষদানা বাঁধতে শুরু করে। শক্তিমান করেদুর্বলের উপর নির্যাতন। হত্যা বা আত্মহত্যাপর্যন্তও গড়ায়। আহা! অমূল্য জীবনের কিকরুণ পরিণতি! জীবন বিসর্জনেও কি সেভুলের খেসারত শেষ হয়ে যায়? তা যেআরও কতদূর গড়ায় সমাজের খোঁজ-খবরনিয়ে কিংবা পত্রপত্রিকার পাতায় নজরবুলালে তার বড় বেদনাদায়ক তফসীল জানাযায়।
দেখা যাচ্ছে ছেলেমেয়ের অমতে যেমনঅভিভাবকের একক সিদ্ধান্তও বিবাহের পক্ষেকল্যাণকর হয় না, তেমনি অভিভাবকবিহীনবিবাহও ছেলেমেয়ের জন্য শুভ হয় না।অনর্থ-অশান্তিই উভয় রকম বিবাহেরসাধারণ পরিণতি। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, কিন্তু ব্যতিক্রম ব্যতিক্রমই। নিয়ম হিসেবে তাকখনও বিচার্য হয় না। সাধারণত যা ঘটেনীতি নির্ধারণে তাই লক্ষবস্ত্ত হয়ে থাকে।অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যখন বিপত্তিই হয়পরিণতি তখন এজাতীয় বিবাহ সম্পূর্ণরূপেপরিহার করা উচিত। উভয়পক্ষেরইবাড়াবাড়ি পরিহার করে মধ্যপন্থায় চলেআসা উচিত। বলাবাহুল্য শরীয়ত প্রদত্তনিয়মই মধ্যপন্থা। তাই অভিভাবকেরও কর্তব্যশরীয়ত তাকে যে সীমা পর্যন্ত ক্ষমতা দিয়েছেসেই সীমাকে অতিক্রম না করা এবংছেলেমেয়েকে দেওয়া শরয়ী অধিকারেরবিলকুল খর্ব না করা আর ছেলেমেয়েরওকর্তব্য নিজ অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রেসংযমী হওয়া, অভিভাবকের অভিভাবকত্বেরযথাযথ মর্যাদা দেওয়া সর্বোপরিশভোনতাবোধের পরিচয় দেওয়া।
বিয়েটা যেহেতু সন্তানের, স্বামী বা স্ত্রীকে নিয়েসংসার জীবন সে-ই যাপন করবে এবংউপযুক্ত বিবাহের সুফল ও অনুপযুক্ততারকুফল মূলত সেই ভোগ করবে তাই তারবিবাহে তার নিজের পছন্দ-অপছন্দই মুখ্যএবং তার মতামতই প্রধান। এটাই যুক্তিরকথা এবং এ অগ্রাধিকার শরীয়তই তাকেদিয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الأيم أحق بنفسها من وليها
সাবালিকা মেয়ের নিজ বিয়ের ব্যাপারেসিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার অভিভাবকঅপেক্ষা তার নিজেরই বেশি। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৪২১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২০৯৮; জামে তিরমিযী, হাদীস : ২০৯৮)
কাজেই তার যদি কোনো পছন্দ থাকে এবংতা তার পক্ষে অসম না হয়, তবেঅভিভাবকের কর্তব্য তার পছন্দকে মূল্যদেওয়া ও তাতে বাধার সৃষ্টি না করা। এমনকিকোনো মেয়ে যদি তার তালাকদাতা প্রাক্তনস্বামীকে ফের বিবাহ করতে চায়, তবে তারক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ অভিভাবককে তাতে বাধসাধতে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআন মজীদেইরশাদ-
فَلَا تَعْضُلُوْهُنَّ اَنْ یَّنْکِحْنَ اَزْوَاجَهُنَّ اِذَا تَرَاضَوْا بَیْنَهُمْ بِالْمَعْرُوْفِ ؕ
তারা যদি ন্যায়সঙ্গতভাবে পরস্পর সম্মত হয়, তবে স্ত্রীগণ নিজেদের (প্রাক্তন) স্বামীদেরকেবিবাহ করতে চাইলে তোমরা তাদের বাধাদিও না। (সূরা বাকারা : ২৩২)
অপরদিকে তাদের যদি কোনো সম্বন্ধ পছন্দনা হয়, তবে তা মেনে নিতে বাধ্য করা যাবেনা। বিশেষভাবে মেয়েদের ক্ষেত্রেঅভিভাবকদের এ প্রবণতা অতি ব্যাপক।সেই প্রাচীন কাল থেকেই এটা চলে আসছে।এই আধুনিককালেও অভিভাবকদের সেমানসিকতায় খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি।অথচ এটা বিলকুল ইসলাম সম্মত নয়।অভিভাবকের যতই পছন্দ হোক না কেন, মেয়ের যদি পছন্দ না হয় তবে সে রকমপাত্রকে মেনে নিতে বাধ্য করার কোনোঅধিকার অভিভাবকের নেই। বাস্তবিকপক্ষেযদি অভিভাবকের সিদ্ধান্ত সঠিক হয় এবংমেয়েই অপরিপক্কতার কারণে তা বুঝতেসক্ষম না হয়, তবে সর্বতোপ্রকারে তাকেবোঝানোর চেষ্টা করা যেতে পারে, কিন্তু চাপপ্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই। যদি চাপদিয়ে তার সম্মতি আদায় করা হয় আরএভাবে অপছন্দের পাত্রের সাথে তাকেবিবাহ দেওয়া হয়, তবে পরবর্তীতে সে বিবাহবলবত রাখা বা নাকচ করার এখতিয়ারপর্যন্ত শরীয়ত তাকে দিয়েছে।হাদীসগ্রন্থসমূহে এরূপ একাধিক ঘটনারউল্লেখ পাওয়া যায়, যাতে এ জাতীয় বিবাহেমেয়েকে এখতিয়ার দেওয়া হয়েছিল। যেমনউম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন, একবার এক তরুণী তাঁর কাছে এসেবলল, আমার বাবা আমাকে তার ভাতিজারসাথে বিবাহ দিয়েছে-উদ্দেশ্য আমার দ্বারাতার হীনাবস্থা ঘুচানো-কিন্তু আমার তাতেসম্মতি ছিল না। উম্মুল মুমিনীন বললেন, তুমি বসো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম আসুন। অতপর রাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এলে তিনিতাঁকে সে ঘটনা অবগত করলেন। তা শুনেতিনি মেয়েটির বাবাকে ডেকে পাঠালেন।তারপর মেয়েটিকে নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্তনেওয়ার এখতিয়ার দিলেন। মেয়েটি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার বাবা যা করেছেনআমি তা অনুমোদন করলাম। আমার উদ্দেশ্যকেবল নারীদেরকে জানানো যে, এ বিষয়েরক্ষমতা বাবাদের হাতে নয়। (সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ৫৩৯০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস: ১৮৭৪; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৫০৮৭)
স্বীকার করতে হবে, তরুণী অত্যন্ত বুদ্ধিমতীছিলেন। একদিকে তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে নালিশকরে জেনে নিলেন এবং নারী সমাজকেসচেতন করে দিলেন যে, নিজ বিবাহেরব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অগ্রাধিকার বিবাহযে করবে তারই এবং সে অধিকার কেবলছেলের জন্য সংরক্ষিত নয়; বরং মেয়েরজন্যও অবারিত। অন্যদিকে নবী সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ হতে তিনিযখন বিবাহ বহাল রাখা-না রাখার এখতিয়ারলাভ করলেন তখন যে পত্রপাঠ বিবাহডিসমিস করলেন তা নয়; বরং সদ্বিবেচনারপরিচয় দিলেন। তিনি পিতার সিদ্ধান্তকেসম্মান জানালেন। জীবনসঙ্গী ও সুখ-দুঃখেরসাথী হিসেবে একদম পছন্দ নয়, কিন্তুতারপরও অভিভাবক হিসেবে পিতাই যেহেতুতাঁকে স্বামী হিসেবে মনোনীত করেছেন, তাইসে মনোনয়নকে খারিজ করে পিতারমর্যাদাকে খাটো করলেন না। তাঁর এ কর্মপন্থাদ্বারাও আমরা ভারসাম্য ও পরিমিতিবোধেরশিক্ষা পাই। অর্থাৎ দৃষ্টি একরোখা হওয়াবাঞ্ছনীয় নয়। লক্ষ দুদিকেই রাখা চাই। নিজপছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটা যেমন আছে, তেমনি অভিভাবকেরও মর্যাদা আছে। আছেসন্তানকে নিয়ে তার স্বপ্ন। তার প্রতি শুভেচ্ছাও কল্যাণকামিতা এবং সর্বাপেক্ষা বেশিকল্যাণকামিতা। নিজ পছন্দকে প্রাধান্য দিয়েএসব অগ্রাহ্য করলে নিঃসন্দেহে তা চরমএকদেশদর্শিতার পরিচায়ক হবে। সন্তান যাতেএ রকম একদেশদর্শী কর্মপন্থা অবলম্বন করেনিজ জীবনে দুর্ভোগ বয়ে না আনে সেজন্যইসলাম অভিভাবকের ভূমিকাকে গুরুত্বদিয়েছে।
একথা অনস্বীকার্য যে, সন্তানের জন্য স্বামী বাস্ত্রী নির্বাচনে সন্তানের নিজের অপেক্ষাঅভিভাবকের বাছাই বেশি সঠিক হয়ে থাকে।কেননা বিয়েটা সন্তানের একান্ত নিজেরহলেও সাধারণত তার দৃষ্টি যেহেতু থাকেনেশাচ্ছন্ন এবং কেবল নিজ জীবনেরপরিমন্ডলে আর তাও দিক-বিশেষের মধ্যেসীমিত। তাই উপযুক্ত বাছাই তার পক্ষে সম্ভবহয়ে ওঠে না। তা সম্ভব হয় অভিভাবকেরপক্ষেই। সন্তানের প্রতি অমিতকল্যাণকামিতার সাথে তার যেহেতু থাকেবাস্তব অভিজ্ঞতা ও বয়সজনিত বিচক্ষণতা, জানা থাকে সন্তানের স্বভাব-চরিত্র ও রুচি-অভিরুচি, সেই সাথে দৃষ্টিতে থাকেপ্রসারতা-সন্তানের, নিজের ও পরিবার-খান্দানের পরিমন্ডল ছাড়িয়েও আঞ্চলিক ওকালিক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে তা ব্যাপ্তথাকে তাই তার নির্বাচনও তুলনামূলক বেশিনিখুঁত ও সুষ্ঠু হয়ে থাকে। সুতরাং সন্তানেরইকল্যাণার্থে তার বিবাহের দায়িত্বও ইসলামঅভিভাবকের উপর ন্যস্ত করেছে।
আল্লাহ তাআলার ইরশাদ-
وَ اَنْکِحُوا الْاَیَامٰی مِنْكُمْ
তোমাদের মধ্যে যারা আয়্যিম (অর্থাৎ যেপুরুষের স্ত্রী ও যে নারীর স্বামী নেই-বিবাহিত, বিপত্নীক, বিধবা যাই হোক না কেন) তাদেরবিবাহ সম্পন্ন কর। (সূরা নূর : ৩২)
কুরআন-হাদীসের এ নির্দেশ সন্তানেরবিবাহদানকে অভিভাবকের একঅবশ্যপালনীয় দায়িত্বই সাব্যস্ত করছে না, সেই সঙ্গে অভিভাবকত্বের ব্যাপারটা যেবিবাহের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ তারওজানান দিচ্ছে। কাজেই এ গুরুত্বকে খাটোকরে দেখার কোনো অবকাশ নেই।অভিভাবকের প্রতি অর্পিত দায়িত্বকে যদিসন্তান নিজের হাতে নিয়ে নেয় এবং নিজেইনিজের বিবাহ সম্পন্ন করে ফেলে তবে সেগুরুত্বকে খাটো করা হয় না কি? এবং তাতেকি খর্ব করা হয় না অভিভাবকের শরীয়ত-প্রদত্ত মর্যাদা? তাই তো অভিভাবকবিহীনবিবাহ যেন সত্যিকারের শরীয়তী বিবাহইনয়। হাদীস সতর্ক করছে, অভিভাবক ছাড়াবিবাহ নেই। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২০৮৫; জামে তিরমিযী, হাদীস : ১১০১)
অর্থাৎ ইসলাম যে বিবাহের ব্যবস্থা দিয়েছেতাতে অভিভাবকেরও একটা ভূমিকা আছে।সে ভূমিকাকে অগ্রাহ্য করে যে বিবাহ হবে তাবৈধতার বিচারে উত্তীর্ণ হলেও একটা অনুষঙ্গবাদ পড়ায় ত্রুটিযুক্ত বিবাহ হবে এবংঅভিভাবকের জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও একটিগুরুত্বপূর্ণ সুন্নতের সংশ্লিষ্টতা না থাকার ফলেতা বহুবিধ কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিতথাকবে। যে কোনও কাজে বড়দের সংশ্লিষ্টতাবরকতপূর্ণ হয়ে থাকে। হাদীসে আছে, বরকততোমাদের বড়দেরই সাথে। (মুসতাদরাকেহাকিম, হাদীস : ২১০; মুজামে আওসাত, তবারানী, হাদীস : ৮৯৯১; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস : ১১০০৪)
অপর বর্ণনায় আছে, কল্যাণ রয়েছেতোমাদের বড়দের সাথে। (মুসনাদে বাযযার) বিবাহ যেহেতু জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একঅধ্যায় এবং কেবল নিজের ভবিষ্যত জীবনইনয়, পরিবার, খান্দান ও পরবর্তী প্রজন্মেরস্বার্থও এর সাথে জড়িত থাকে তাই এক্ষেত্রেকল্যাণ ও বরকতকে ছোট করে দেখারকোনো উপায় নেই। কল্যাণ-বরকতহীনবিবাহ সংশ্লিষ্ট সকলের পক্ষেই মসিবতেরকারণ। তাই তো বিবাহের পর বরকতের জন্যদুআ করা হয়-
بَارَكَ اللهُ لَكَ وَبَارَكَ اللهُ عَلَيْكَ وَجَمَعَ بَيْنَكُمَا بِخَيْرٍ
আল্লাহ তাআলা তোমাকে এ বিয়েতেবরকত দান করুন, বরকত দিন তোমারসত্ত্বায় এবং তোমাদের দাম্পত্যকেকল্যাণময় করুন। (জামে তিরমিযী, হাদীস : ১০৯১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২১৩০)
তো কল্যাণ ও বরকতের স্বার্থেই বিবাহেঅভিভাবকের সংশ্লিষ্টতা জরুরি।অভিভাবকবিহীন বিবাহ যে কল্যাণময় হয় নাতা কেবল যুক্তিতর্কের বিষয় নয়; বরং এমনইএক বাস্তবতা, যা চারদিকে নজর দিলে যেকারও চোখে পড়বে। এমনকি এজাতীয়বিবাহ টেকসইও হয় না। ক্রমবর্ধমানবিবাহবিচ্ছেদের এটাও একটা বড় কারণ।কাঁচাবুদ্ধির বন্ধন তো পরিপক্ক হওয়ারও কথানয়। বিশেষত যে সকল মেয়ে অভিভাবককেএড়িয়ে এ পথে ঝাঁপ দেয়-যে কি নাস্বভাবতই আবেগপ্রবণ ও কোমলমতি, জীবনও জগতের ঘোরপ্যাচ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, তাদের আবেগতাড়িত বন্ধন যেন বালিরবাঁধ। আকছারই টেকে না। সেই সতর্কবাণীইহাদীসে উচ্চারিত হয়েছে, যে কোনো নারীতার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিবাহকরে, তার বিবাহ বাতিল বাতিল বাতিল।(সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২০৮৩; জামেতিরমিযী, হাদীস : ১১০২)
অর্থাৎ অসম বিবাহ হলে তো অভিভাবকআদালতের মাধ্যমে তা নগদই বাতিলকরাতে পারে আর যদি অসম নাও হয় তবুতা অতি ক্ষণস্থায়ী হয়। নানাবিধ অসংগতিরকারণে সাধারণত বিচ্ছেদই হয় তারপরিণতি।
সারকথা সন্তান ও অভিভাবক উভয়কেইপারস্পরিক দায়িত্ব ও অধিকারের মর্যাদা রক্ষাকরতে হবে। অভিভাবককে চিন্তা করতে হবেবিবাহটা যেহেতু সন্তানের তাই মতামতেরক্ষেত্রে অগ্রাধিকার তারই। কাজেই তারঅমতে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না এবংনিজ সিদ্ধান্তকে তার উপর চাপিয়ে দেওয়াযাবে না। অন্যপক্ষে সন্তানকেওঅভিভাবকের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে, তাঁরস্বপ্ন ও শুভাকাঙ্ক্ষাকে মূল্যায়ন করতে হবেএবং নিজেরই স্বার্থে তার অভিজ্ঞতা ওজ্ঞান-প্রজ্ঞাকে কাজে লাগানোর সুযোগদিতে হবে। অর্থাৎ মতামত দানেরঅগ্রাধিকার যেমন সন্তানের, তেমনি সন্তানেরবিবাহ সম্পাদনে অগ্রণী ভূমিকা পালনেরদায়িত্ব অভিভাবকের! এটাই মধ্যপন্থা এবংএতেই বরকনেসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কল্যাণ।
(৩য় পর্ব সমাপ্ত।)
(তথ্য:মাসিক আলকাউসার। সফর ১৪৩৫হিঃ)
#alhudabd
No comments