Header Ads

Header ADS

ইসলামে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব (পর্ব-৯)

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম
বিপদাপদের বিচার-বিশ্লেষণে (৩)
এত বড় মসিবত তার! কী পাপ যেন করেছে! কারও মসিবত দেখলে এজাতীয় মন্তব্য বা এ ধরনের মনোভাব পোষণ একটি সাধারণ প্রবণতা। অন্যের বিপদ দেখলেই দৃষ্টি চলে যায় পাপের দিকে। যেন পাপ না থাকলে বিপদ আসতে পারে না। এমনকি যে ব্যক্তি নিজের বিপদকালে কী পাপ করেছি, যে কারণে এমন বিপদ-বলে আক্ষেপ করে, সে-ও অন্যের বিপদে তার পাপকেই দায়ী করে। অর্থাৎ নিজেকে পবিত্র ও অন্যকে পাপী ঠাওরানো এক সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। অথচ নিজের বেলায় দরকার ছিল পাপের দিকে নজর বুলানো এবং তওবা-ইস্তিগফার করে আত্মশুদ্ধির পথে পা বাড়ানো আর অন্যের বেলায় উচিত সুধারণা পোষণ। কুরআন-হাদীসে স্পষ্টভাবেই অন্যের প্রতি কুধারণা পোষণ করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং হুকুম করা হয়েছে যেন এক মুসলিম অন্য মুসলিম সম্পর্কে সুধারণা রাখে।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, বালা-মসিবত পাপাচারের কারণেও দেখা দেয়, যেমনটা পূর্বের আলোচনায় গত হয়েছে। আরও স্পষ্ট করা হয়েছে-মুমিনদের পক্ষে বালা-মসিবত ক্ষতিকর নয়; বরং তার ভেতর তাদের প্রভূত কল্যাণ নিহিত থাকে। কাজেই কোনও মুসলিমের বিপদ যদি তার পাপের কারণেও হয়, তবু অন্যদের জন্য এটা কিছুতেই শোভন নয় যে, তারা তার পাপের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে তাকে হেয় জ্ঞান করবে কিংবা পাপের ফল ভোগ করছে ভেবে আহ্লাদিত হবে। এটা একরকম নীচতা ও অমানবিকতা। বাস্তবিকই যদি পাপের কারণে হয়ে থাকে, তবে সে তো বিপদ দ্বারা ঝালাই হয়ে পাপ থেকে মুক্ত ও পবিত্র হয়ে যাবে এবং আল্লাহ চাহেন তো এ বিপদ তার মানবিক উৎকর্ষেরও অছিলা হয়ে যাবে, অপরদিকে যারা তার সম্পর্কে কুধারণা করেছে তারা অহেতুক নিজেদের পাপভার বৃদ্ধি করবে। সেই সাথে যদি আহ্লাদও বোধ করে থাকে, তবে তো অনুরূপ বিপদের ঝুঁকিতেও পড়ে যাবে। সুতরাং যে ব্যক্তি প্রকাশ্য পাপাচারী নয়, তার কোন মসিবত দেখা দিলে সে মসিবত যে তার কোন পাপেরই ফল এরূপ ধারণা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কেননা বালা-মসিবত দ্বারা আল্লাহ তাআলা মানুষকে পরীক্ষাও করে থাকেন। আল্লাহ তাআলা দেখেন বিপণ্ণ ব্যক্তি নিজে বিপদকে কোন দৃষ্টিকোন থেকে নিচ্ছে এবং তাতে সে কী কর্মপন্থা অবলম্বন করছে। সেই সঙ্গে অন্যদেরও পরীক্ষা নেওয়া হয় যে, তারা বিষয়টাকে কীভাবে দেখছে এবং বিপণ্ণ ব্যক্তির সাথে কি রকম আচরণ করছে।
কুরআন মজীদে ইরশাদ-
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ l الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ
 আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব ভয়-ভীতি ও ক্ষুধা দ্বারা এবং জানমাল ও ফসলহানি দ্বারা। যেসব লোক সবরের পরিচয় দেয় তাদেরকে সুসংবাদ শোনাও, যারা তাদের কোন মসিবত দেখা দিলে বলে ওঠে, আমরা সকলে আল্লাহরই এবং আমাদেরকে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে। (বাকারা : ১৫৫-১৫৬)
আল্লাহ তাআলা বলছেন لنبلونكم আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব। ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি بلاء (বালা) থেকে। বালা মানে পরীক্ষা। বলা হচ্ছে, শত্রু কোন ক্ষতি করবে এই ভয়, অভাব-অনটন ও ক্ষুধার কষ্ট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ফসলহানি, ব্যবসায়ে ভরাডুবি, অনাকাঙ্ক্ষিত অর্থক্ষয়, রোগ-ব্যাধি ও প্রিয়জনের বিয়োগ প্রভৃতির মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা বান্দাকে পরীক্ষা করেন। পরীক্ষা করা হয় সবরের। দেখা হয় সে কি বিপদে দিশাহারা হয়ে ভাগ্যকে দোষারোপ করে? আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে অভিযোগ করে? মানুষের কাছে নিজ ভাগ্য-বিপর্যয়ের কথা গেয়ে বেড়ায়? বেফাঁস কথা বলে নিজ ঈমান-আমলের সর্বনাশ ঘটায়? নাকি এক আল্লাহর অভিমুখী হয়ে তাঁরই কাছে ফরিয়াদ জানায়, তাঁর ফয়সালাকে মেনে নিয়ে নিজ দুর্বলতা ও অসহায়ত্বের কথা তাঁরই সমীপে নিবেদন করে, কেবল তাঁরই কাছে সাহায্য চায় এবং কথায় ও কাজে এ বিশ্বাসের পরিচয় দেয় যে, বিপদাপদ কেবল তিনিই দিয়ে থাকেন এবং তা দূরও কেবল তিনিই করতে পারেন? এর সারকথা হল আল্লাহতে আত্মসমর্পিত হওয়া। এটাই সবরের সারবস্ত্ত। বিপদাপদে যে ব্যক্তি সবর অবলম্বন করবে তথা আল্লাহতে আত্মসমর্পিত হতে পারে সে-ই পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়। তার কাছে এ কৃতকার্যতাই কাম্য। এটা তার উন্নতি ও উৎকর্ষের সোপান। পরীক্ষা তো ক্রমোন্নতির জন্যই হয়ে থাকে।
বান্দা যাতে সবরের মাধ্যমে ধাপে ধাপে উন্নতি লাভ করত আল্লাহ তাআলার মাইয়্যাত ও পরম নৈকট্যের স্তরে উপনীত হতে পারে সে লক্ষেই তাকে বিপদাপদ দেওয়া হয়ে থাকে। তাই বিপদাপদের নাম বালা-পরীক্ষা। কুরআন মজীদের বহু আয়াতে বিপদাপদকে বালা শব্দেই ব্যক্ত করা হয়েছে। কুরআনের অনুসরণে মুসলিম গণ-মানুষের ভাষাতেও এ শব্দটি বিপদাপদের সমার্থকরূপে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। এখন যূথবদ্ধভাবেই বলা হয় বালা-মসিবত, রোগ-বালাই, আপদ-বালাই ইত্যাদি। অর্থাৎ এখন বালা ও বিপদ একই অর্থ বহন করে। প্রকৃতপক্ষে দুটো প্রতিশব্দ নয়। বিপদ তো বলা হয় দুর্দশা, দুরবস্থা, দুর্ঘটনা ও ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটকে, যা ব্যুৎপত্তিগতভাবে নেতিবাচক। কিন্তু বালা অর্থ পরীক্ষা। এটা সম্পূর্ণ ইতিবাচক। দুর্দশা ও দুরবস্থাকে বালা এ কারণে বলে যে, তা দ্বারা বান্দার ধৈর্যের পরীক্ষা নেওয়া হয় এবং এর মাধ্যমে তার আত্মিক উন্নতি লাভ হয়। অর্থাৎ অহমিকা ও অবাধ্যতা থেকে পরিশুদ্ধি এবং আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল ও আত্মসমর্পণের গুণ অর্জিত হয়। কিন্তু বহুল ব্যবহারের ডামাডোলে শব্দটির এ তাৎপর্য আজ হারিয়ে গেছে। এখন বালা বলতে কেবল তাৎপর্যহীনভাবে বিপদাপদকেই বোঝায়। এর দ্বারা যে পরীক্ষাও নেওয়া হয় সেদিকে কারও দৃষ্টি যায় না। আর তা যায় না বলেই মুখে বালা-মসিবত বলা সত্ত্বেও বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি পরীক্ষার্থীর মত উত্তরণের গরজ বোধ করে না।
ওই তাৎপর্য বিস্মৃত হওয়ার আরও একটি কুফল হল শব্দটির প্রয়োগ-সংকোচন। যদ্দরুণ আমরা মসিবতে যেমন ধৈর্যহারা, তেমনি নিআমতে নাশোকর। অর্থাৎ কুরআন মজীদে বালা শব্দটির প্রয়োগক্ষেত্র ব্যাপক। বিপদাপদকে যেমন বালা বা পরীক্ষা বলা হয়েছে তেমনি নিআমত ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকেও। ইরশাদ হয়েছে-
وَنَبْلُوكُمْ بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً وَإِلَيْنَا تُرْجَعُونَ
আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভালো দ্বারা বিশেষভাবে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই কাছে তোমাদেরকে ফিরিয়ে আনা হবে। (সূরা আম্বিয়া : ৩৫)
অন্যত্র ইরশাদ-
وَلِيُبْلِيَ الْمُؤْمِنِينَ مِنْهُ بَلَاءً حَسَنًا إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
মুমিনদেরকে তিনি নিজের পক্ষ হতে উত্তম বালা (পুরস্কার) দিতে চান বলে। (আনফাল : ১৭)
আরও ইরশাদ,
  فَأَمَّا الْإِنْسَانُ إِذَا مَا ابْتَلَاهُ رَبُّهُ فَأَكْرَمَهُ وَنَعَّمَهُ فَيَقُولُ رَبِّي أَكْرَمَنِl  وَأَمَّا إِذَا مَا ابْتَلَاهُ فَقَدَرَ عَلَيْهِ رِزْقَهُ فَيَقُولُ رَبِّي أَهَانَنِ
 মানুষ তো এমন যে, তার প্রতিপালক যখন তাকে পরীক্ষা করেন সম্মান ও নিআমত দান করে, তখন সে বলে আমার প্রতিপালক আমাকে সম্মানিত করেছেন এবং যখন তাকে পরীক্ষা করেন তার রিযক সংকুচিত করে তখন সে বলে আমার প্রতিপালক আমাকে হীন করেছেন। (ফাজর : ১৫-১৬)
মোটকথা পরীক্ষার ভেতর আছে সকলেই। সবটা অবস্থাই পরীক্ষা ও বালা। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যও বালা, দুঃখ-কষ্টও বালা। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার উপায় হল শুকর আদায় আর দুঃখ-কষ্টের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার উপায় সবরের পরিচয় দান। কিন্তু আমাদের অবস্থা বড় আজব। আমরা কোন অবস্থাকেই সাধারণত পরীক্ষা মনে করি না। সুখের অবস্থায় উল্লসিত হই আর দুঃখের অবস্থায় হতাশ। অথচ তা যাতে না হই, সেজন্যেই উভয় অবস্থাকে বালা শব্দে ব্যক্ত করত আমাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে যে, প্রকৃতপক্ষে তোমাদের জন্য কোন অবস্থাই মন্দ নয়, যদি তোমরা সে অবস্থাকে পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ কর এবং তার দাবি অনুযায়ী কাজ কর। সুতরাং তোমাদের কর্তব্য সেই দাবি পূরণে মনোযোগী হওয়া অর্থাৎ সুখে শুকর ও দুঃখে সবর করা।
আল্লাহ তাআলা জানেন মানুষ বড় দুর্বল। তাই মানুষকে দুঃখ-কষ্টের পরীক্ষায় অপেক্ষাকৃত কমই ফেলেন। দুনিয়ায় তিনি মানুষকে দিয়েছেন অপরিমিত নিআমত। ইরশাদ হয়েছে-
وان تعدوا نعمة الله لا تحصوها
তোমরা আল্লাহর নিআমত গুনলে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। বস্ত্তত মানুষ অতিমাত্রায় জালেম ও অকৃতজ্ঞ। (ইবরাহীম : ১৪)
প্রত্যেকেই লক্ষ করলে দেখবে মন্দাবস্থা অপেক্ষা তার ভালো অবস্থাই বেশি। সে অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করেই দমে যায়। তুলনায় পেছনে না পড়ে নিজের যা আছে তার হিসাব নিলে প্রত্যেকেরই নিজেকে ঐশ্বর্যশালী মনে হত ও কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসত। কিন্তু মানুষ নিজের চেয়ে কে বেশি বিত্তবান, কে বেশি স্বাস্থ্যবান, কে বেশি ক্ষমতাবান, কে বেশি মর্যাদাবান এবং আরও কোন দিক থেকে কে বেশি তা দেখতেই আগ্রহী। সেই অনুচিত আগ্রহই তার সব নষ্টের মূল। এরই কারণে কেবল নিজের কমতিটাই চোখে পড়ে, অভাবের দিকে নজর যায়, নিজেকে দুঃখী মনে হয়, অন্তরে হীনম্মন্যতা জন্মায় ও বিপদাপদে হতাশ দেখা যায়।
কোন বিপদের সম্মুখীন হলে তার পাশাপাশি নিআমাতসমূহের প্রতিও নজর দেওয়া চাই। কেবল একটি কষ্টকে নজরে রেখে আরও দশটি স্বস্তিকে উপেক্ষা করলে তা হবে একদেশদর্শিতা। দৃষ্টির ভারসাম্য ছাড়া সুবিচার হয় না। তাই দৃষ্টি ঘোরানো চাই দুদিকেই। তাতে বিবেচনা সুষ্ঠু হয়। তাছাড়া কষ্টের পাশাপাশি স্বস্তির দিকে নজর রাখলে কষ্টের মাত্রাও লাঘব হয়। তারপরও মানবীয় দুর্বলতার কারণে কষ্টের একটি কারণ যদি স্বস্তির দশটি কারণকে ছাপিয়ে যায়, তবে সে কষ্টে আত্মনিয়ন্ত্রণের উপায় কেবল পরীক্ষার চেতনাকে উজ্জীবিত রাখা। অর্থাৎ যে কোন বিপদ দেখা দিলে চিন্তা করা-আল্লাহ তাআলা বিপদ দেন বান্দাকে ধ্বংস করার জন্য নয়, বরং তার সবরের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য, আত্মার মলিনতা দূর করে তাকে বন্দেগীর উচ্চতর স্তরে পৌঁছানোর জন্য। আল্লাহ তাআলার ঘোষণা-
ان الله مع الصابرين
 আল্লাহ সবরকারীদের সঙ্গে। সেই সঙ্গ ও পরম নৈকট্য দানের জন্যই তিনি বিপদাপদের চুল্লি স্থাপন করেন। সেই ব্যক্তি বড় ভাগ্যবান যে এই চুল্লিতে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর মনে-প্রাণে নিজেকে আল্লাহ তাআলার হাতে সঁপে দেয় আর ভাবে, জগত-সংসারের সব কিছুই আল্লাহর, আমি আল্লাহর, আমার প্রতিটি অংগ-প্রত্যংগ আল্লাহর, আমার সম্পূর্ণটা অস্তিত্ব আল্লাহর, আমার ধন ও জন আল্লাহর এবং আমার বলতে যা কিছু ভাবি সবই আল্লাহর। আর এই ভাবনায় মুখের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণ হয়-
انا لله وانا اليه راجعون
আমরা সকলে আল্লাহর এবং আমাদের সকলকে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে।আমি ও আমার সব কিছু তাঁরই কাছে ফিরে যাবে। সেই মহা মালিকের ইচ্ছায়ই আজ হয়ত আমার একটা অঙ্গ চলে গেছে, খানিকটা শক্তি চলে গেছে, কিছু সম্পদ চলে গেছে, একজন প্রিয়জন চলে গেছে, রয়ে গেছে আরও অনেক, এক সময় সবই চলে যাবে, এই যাওয়াতেই পূর্ণতা, যার ধন তার কাছে ফিরে যাওয়াতেই সার্থকতা।
হাঁ, আমার সাময়িক ও কৃত্রিম মালিকানা আছে। সেই মালিকানার টানে যে কোনও বিয়োগ বেদনাদায়ক। ব্যাথা পাই নিজ দুর্বলতার কারণেও। তাই হে মহা-মালিক, জানি আমার কল্যাণার্থেই তুমি এই চুল্লিতে আমাকে ফেলেছ, কিন্তু আমি বড় দুর্বল। দহন-যন্ত্রণা সইবার শক্তি আমার নেই। যে কল্যাণের ফয়সালা তুমি করেছ তা আমাকে দিয়ে দাও আর দুঃখ-বেদনা আমার থেকে সরিয়ে নাও।
এই আত্মসমর্পণ বান্দাকে ধাপে ধাপে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছিয়ে দেয়। আর যত বেশি নৈকট্য লাভ হয়, পরীক্ষাও তত কঠিন হতে থাকে। বলাবাহুল্য নিম্নশ্রেণী অপেক্ষা উচ্চ শ্রেণীর পরীক্ষা বেশি কঠিনই হয়ে থাকে। জাগতিক পাঠশালার ক্ষেত্রে তা বুঝলেও ইলাহী পরীক্ষাগারের এ রহস্য অনুধাবন করি না। তাই বিপণ্ণ মাত্রকেই পাপের খেসারতদাতা ভাবি। চিন্তা করি না যে, এটা তার পরীক্ষাও হতে পারে এবং আল্লাহ তাআলার বেশি প্রিয় বলেই হয়ত তার পরীক্ষা এত কঠিন নেওয়া হচ্ছে।
সব যুগেই আল্লাহর প্রিয় বান্দাদেরকে কঠিন কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছে। এমন কঠিন পরীক্ষা, আমাদের সাধারণদের পক্ষে যার কল্পনা করাও কঠিন। কুরআন মজীদে তাদের সে পরীক্ষার চিত্রাঙ্কন করা হয়েছে এভাবে-
مَسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللَّهِ
অর্থ-সংকট ও দুঃখ-কষ্ট তাদেরকে স্পর্ষ করেছিল এবং তারা ভীত ও কম্পিত হয়েছিল। এমন কি রাসূল এবং তাঁর সাথে ঈমান আনয়নকারীগণ বলে উঠেছিল, আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? (বাকারা : ২১৪)
ভাবুন তো দেখি পরিস্থিতি কি রকম কঠিন হলেই পর্বতপ্রমাণ ধৈর্য-স্থৈর্যের মালিক, বিস্ময়কর মনোবলসম্পন্ন নবীগণ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হন-আল্লাহর সাহায্য কখন?
অগ্নিপরীক্ষা বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই তাদের থেকে নেওয়া হয়েছিল। তা দ্বারা আমরা স্বান্ত্বনা পেতে পারি, অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারি এবং পারি অন্তরে হিম্মত যোগাতে। আমাদের কারও বিপদ যত বড়ই হোক তা তাঁদের বিপদের সাথে কিছুতেই তুলনীয় হতে পারে না। আমাদের ঈমান সাধারণ স্তরের বলেই লঘু বিপদ দ্বারা আমাদেরকে পরখ করা হয়। সেই লঘু বিপদে দিশাহারা না হয়ে আমরা তাকাতে পারি মানব জাতির সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি। তারা তো ফেরেশতা নয়; বরং মানুষই ছিলেন। আমাদের মতই তাদের সুখ-দুঃখের অনুভূতি ছিল। ক্ষুৎ-পিপাসার কষ্ট তাঁদেরকেও কাতর করত। সর্বপ্রকার ক্ষতি ও ভীতির সম্মুখীন তারাও হতেন এবং অনেক বেশি পরিমাণেই হতেন। তারা মাসূম ও নিষ্পাপ ছিলেন। তা সত্ত্বেও এমন কঠিন কঠিন বিপদের মুখে তারা পড়ে যেতেন, যা তাদের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিত। কেন এমনটা হত? এজন্য যে, তারা আল্লাহ তাআলার সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয় ছিলেন। তাই কঠিন বিপদ দ্বারা সর্বাপেক্ষা কঠিন পরীক্ষা তাদেরই নেওয়া হত। আমরা যদি তাঁদের পথের অভিযাত্রী হয়ে থাকি এবং হয়ে থাকি আল্লাহপ্রেমের দাবিদার, তবে কিছু না কিছু পরীক্ষা আমাদেরও দিতে হবে বৈকি! সুতরাং যদি হয়ে পড়ি শত্রুবেষ্টিত, তবে সামনে উত্তাল সাগর ও পেছনে সসস্ত্র প্রমত্ত শত্রুবাহিনী এই ঘোর বিপদকালে আমার সঙ্গে আল্লাহ আছেন-নবী মুসা আলাইহিস সালামের এই অচঞ্চল উচ্চারণ পারে আমার সম্বিত ফেরাতে। প্রিয়জন হারা ব্যথিতের বেদনা নিমিষেই ঘুচে যেতে পারে হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের কল্পনা। উপর্যুপরি বিরহযাতনায় ক্লিষ্ট এ মহান নবী তাকে দেখিয়ে দেয় পরম নির্ভরতার ঠিকানা-
إِنَّمَا أَشْكُو بَثِّي وَحُزْنِي إِلَى اللَّهِ
 আমি তো আমার দুঃখ-বেদনার নালিশ কেবল আল্লাহর কাছে জানাই। (ইউসুফ : ৮৬)
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম, আয়্যূব আলাইহিস সালাম, ঈসা আলাইহিস সালামসহ আরও যত নবী-রাসূল আছেন, কোন আর্ত তাদের কাছে না পাবে কর্তব্যনির্দেশের পরম বার্তা? আর একান্ত নিজেরজন নবী মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো হাতের কাছেই। এমন কোন বিপদগ্রস্ত আছে, যে সমজাতীয় বিপদের সবচে বড়টার তান্ডব সেখানে দেখতে পাবে না? সেই শুভ্র-কোমল জ্যোতির্ময় সত্ত্বা কোন্ আঘাতে জর্জরিত না হয়েছে? এক ইফক-এর ঘটনাই সারা বিশ্বের সমস্ত বিপণ্ণকে ধৈর্য-স্থৈর্য ও আল্লাহ নির্ভরতায় সম্বুদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট।
মোদ্দাকথা ইহজগত সুখ-দুঃখের মিশ্রণেই তৈরি। এমন জীবন এখানে অসম্ভব, যা কেবল সুখই ভোগ করবে, আবার এমন জীবনও কারও থাকতে পারে না যা শুধুই দুঃখময়। সে জন্য আছে আখিরাতে জান্নাত ও জাহান্নাম। কিছু সুখ ও কিছু দুঃখ নিয়ে ইহজীবনের সচলতা। তবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে দুঃখ-কষ্টের তুলনায় সুখ-সাচ্ছন্দ্যের উপস্থিতিই বেশি। আমার ক্রোধের উপর আমার করুণা প্রবল-এই ইলাহী ঘোষণাই সর্বত্র কার্যকর। তিনি অফুরন্ত নিআমতের মধ্যে বান্দাদের ডুবিয়ে রেখেছেন। তাই তো ডাক দিয়ে বলেন, তোমরা আমার কোন কোন নিআমতকে অস্বীকার করবে?
ইহজীবনে মানুষ যে দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হয় তা কখনও হয় তার পাপের শাস্তিতে, কখনও তা দ্বারা মানুষের মাপ মোচন উদ্দেশ্য থাকে, কখনও তা দ্বারা বান্দাকে আল্লাহর ইপ্সিত মর্যাদায় পৌঁছানো হয় এবং কখনও উদ্দেশ্য হয় মানুষকে পরীক্ষা করা।
তাই গড়পড়তা সব মসিবতকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা ঠিক নয় এবং সব বিপদগ্রস্তকে পাপী বা বিপদমাত্রকেই পাপের ফল ঠাওরানো সংগত নয়। বিপণ্ণ ব্যক্তির নিজেরও উচিত নয় যে কোন বালা-মসিবতকে অশুভ গণ্য করা। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَعَسَى أَنْ تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَكُمْ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
তোমরা যা পসন্দ কর না এমন হতেই পারে যে, তা তোমাদের পক্ষে কল্যাণকর, আবার এমনও হতে পারে যে, তোমরা যা পসন্দ কর তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না। (বাকারা : ২১৬)
বরং সর্ববিচারে বালা-মসিবত মুমিনের পক্ষে কল্যাণকরই হয়ে থাকে, বিশেষত যখন দেখা যাচ্ছে সর্বকালে আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণই তুলনামূলকভাবে বেশি বালা-মসিবতের সম্মুখীন হয়েছেন।
সুতরাং ওহে মুমিন! তুমি কোন দুঃখে বলবে ভালো নেই! যখন বালা-মসিবত অপেক্ষা স্বস্তির হালই বেশি। আবার বালা-মসিবতও আখেরে সুফলই বয়ে আনে তখন তুমি মন্দ হালে নও তো কিছুতেই। প্রাণভরে বল, ভালো আছি। মনের মাধুরি মিশিয়ে বল, আলহামদুলিল্লাহ, আমি ভালো আছি। 
(৯ম পর্ব সমাপ্ত)

(তথ্য:মাসিক আলকাউসার। শাবান-রমযান ১৪৩৫হিঃ)
#alhudabd 

No comments

Powered by Blogger.